শিং মাছ চাষে আয় করুন লক্ষ টাকা
স্বদেশ জার্নাল → প্রকাশ : 13 Jul 2022, 4:49:29 PM


পার্বতী রানী দেওয়ানজী
পুকুরে শিং মাছ চাষ এটি একটি লাভজনক চাষ। ভাল করে চাষ করতে পারলে কার্পজাতীয় মাছের তুলনায় শিং মাছ চাষে লাভ বেশি হয় । শিং মাছের বৈজ্ঞানিক নাম Heteropneustes fossilis . এটি একটি বাংলাদেশের Native মাছ। মাছটিকে Stinging catfish ইংরেজিতে বলে। দেহ কোন আঁশ নাই কিন্তু মুখে গোঁফ আছে। খেতে সুস্বাদু। শিং মাছ সাদু পানির মাছ।
১.শিং মাছ চাষের নার্সারী পদ্ধতি :
মাছ চাষে ভাল ফলাফল পেতে হলে প্রতি টি প্রজাতির মাছকে নার্সিং করা জরুরী। শিং মাছ নার্সিং করার জন্য ১০ থেকে ৪০ শতাংশের পুকুর নির্বাচন করা ভাল। পুকুরের পাড় যাতে ভাল একটু উঁচু হয় সেই দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। পুকুরে যেন রোদের আলো পরে এমন পুকুর শিং মাছের নার্সিং চাষের জন্য নির্বাচন করতে হবে।
১.১ শিং মাছ চাষের নার্সারী পুকুর প্রস্তুতি:
প্রথমে পুকুরের সম্পূর্ণ পানি শ্যালো মেশিন দিয়ে শুকিয়ে ফেলতে হবে। পুকুরের তলায় এক দিন রোদর দিতে হবে । পুকুরের তলায় অতিরিক্ত কাঁদা ও পঁচা আর্বজনা শামুক থাকলে তুলে ফেলতে হবে । চারপাশে লতাপাতা কচুরিপানা থাকলে ভাল করে পরিষ্কার করতে হবে। পুকুরের পাড়ে বড় কোন গাছ পালা থাকলে ছাঁটাই করে দিতে হবে। পুকুরের তলায় মই টেনে মাটি সমান করে দিতে হবে। তারপর প্রতি শতাংশে ৫০০ গ্রাম হারে চুন ও ১৫০ হারে জিওলাইট প্রয়োগ করতে হবে। প্রতি শতাংশে ২৫০ গ্রাম হারে লবণ দিতে হবে । পুকুরের তলায় যদি গ্যাস থাকে তাহলে গ্যাস উত্তোলন করার জন্য “গ্যাস টপ ” ঔষধ দিতে হবে ।
চুন , জিওলাইট ,লবণ, গ্যাস টপ প্রয়োগ করার ১২ ঘণ্টা পরে পুকুরে পরিষ্কার পানি দিতে হবে। পুকুরে পানি দেওয়ার আগেই পাড়ের উপরের চারপাশে ৩ ফোট উঁচু নেট জাল দিয়া বেড়া দিতে হবে । সাঁপ, ব্যাঙে পোনা খেতে না পারে তাই জাল বেড়া দিতে হয়। পানি দেওয়ার ৭২ ঘণ্টা পরে পুকুরে শিং মাছের রেণু মাছ ছাড়া যাবে। রেণু ছাড়ার সময় পুকুরের পানির সাথে অক্সিজেন ব্যাগ এর পানি ম্যাচ করে ছাড়তে হবে। প্রতি শতাংশে ৫ থেকে ১০ গ্রাম শিং মাছের রেণু ছাড়া যাবে। ১০ শতাংশ একটি নার্সিং পুকুরের জন্য সর্বউচ্চু ১ কেজি শিং মাছের রেণু ছাড়া যাবে। শিং মাছের নার্সিং পুকুরের ৩ থেকে ৪ ফোট পানি রাখতে হবে । ৪ ফোটের বেশি পানি থাকলে পানি সেচ দিয়ে কমিয়ে রাখতে হবে।
১.২ নার্সিং পুকুরে শিং মাছের খাদ্য:
প্রথম তিন দিন শিং মাছের রেণু কে সিদ্ধ ডিমের কুসুম খাওয়াতে হবে। ১ কেজি রেণুর জন্য প্রতিদিন ১৬ টি সিদ্ধ ডিমের কুসুম খাওয়াতে হবে। সকলে ৮টি বিকাল বা রাতে ৮ টি ডিমের কুসুম খাওয়াতে হবে। সিদ্ধ ডিমের কুসুম পরিষ্কার পানির সাথে ভাল করে মিশিয়ে সমস্ত পুকুরের সমান ভাবে ছিটিয়ে দিতে হবে। তিন দিন পরে প্যাকেট জাতীয় পাউডার ফিস ফিড দিতে হবে যেমন রেণু গোন্ড, টাইগার ব্রান্ড ইয়ন নার্সারী ফিড। এগুলো পানির সাথে মিশিয়ে ভাল করে পুকুরের সমান ভাবে ছিটিয়ে দিতে হবে। তবে পাউডারের ফিড এর সাথে সরিষার খৈল ভিজিয়ে মাছকে খাওয়ানো যাবে। প্রথম সপ্তাহে মাছের ওজনের ১০০% খাবার দিতে হবে। অর্থাৎ ১ কেজি রেণু জন্য প্রতিদিন ১ কেজি খাবার দিতে হবে। শিং মাছের রেণু প্রতিদিন ৩ বেলা খাবার দিতে হবে। মাছ বড় হওয়ার সাথে সাথে মাছের খাবার আস্তে আস্তে বাড়িয়ে দিতে হবে। শিং মাছ চাষের ক্ষেত্রে পুকুরের পানির কালার হলকা সবুজ রাখতে হবে। হয়। পানি দেওয়ার ৭২ ঘণ্টা পরে পুকুরে শিং মাছের রেণু মাছ ছাড়া যাবে। রেণু ছাড়ার সময় পুকুরের পানির সাথে অক্সিজেন ব্যাগ এর পানি ম্যাচ করে ছাড়তে হবে। প্রতি শতাংশে ৫ থেকে ১০ গ্রাম শিং মাছের রেণু ছাড়া যাবে। ১০ শতাংশ একটি নার্সিং পুকুরের জন্য সর্বউচ্চু ১ কেজি শিং মাছের রেণু ছাড়া যাবে। শিং মাছের নার্সিং পুকুরের ৩ থেকে ৪ ফোট পানি রাখতে হবে । ৪ ফোটের বেশি পানি থাকলে পানি সেচ দিয়ে কমিয়ে রাখতে হবে।
১.৩ শিং মাছের রেনু নার্সিং পুকুরে রোগ ব্যাবস্থাপনা:
শিং মাছের রেণুর সবচেয়ে বড় সমস্যা হল ভাইরাস । পুকুরে একবার ভাইরাস হলে শিং মাছকে আর বাঁচানো যায় না। তাই মাছে যাতে ভাইরাসে আক্রান্ত না হয় তার জন্য আগে থেকেই প্রতি শতাংশে ২ গ্রাম হারে টিমসেন বা ভাইরেক্স প্রয়োগ করতে হবে। তাছাড়া রোগ প্রতিরোগ ব্যবস্থা হিসাবে প্রতি সপ্তাহে লবণ -২০০ গ্রাম , পটাশ – ২.৫ গ্রাম, পরিমাণ মত ভিটামিন সি প্রয়োগ করতে হবে। পুকুরে যদি অক্সিজেনের অভাব হয় তাহলে অক্সিজেনের ট্যাবলেট অক্সি টেপ বা অক্সি গোল্ড অথবা অক্সিমোর প্রয়োগ করতে হবে। পুকুরের তলায় অতিরিক্ত গ্যাস হলে আস্তে আস্তে হয়রা টানতে হবে অথবা গ্যাস উত্তোলনের জন্য গ্যাসোনেক্স প্রয়োগ করেত হবে।
২.শিং মাছের কালচার চাষ পদ্ধতি :
সাধারণত নার্সিং কারার পরে নার্সিংকৃত পোনা বাজারে বিক্রয় করার আগ পর্যন্ত যে চাষ প্রক্রিয়া করা হয় সেটাই হল কালচার চাষ পদ্ধতি। শিং মাছের কালচার পুকুরের আয়তন ৩০ থেকে ১০০ শতাংশের মধ্যে হলে ভাল হয়।
২.১ শিং মাছের কালচার পুকুর প্রস্তুতি :
কালচার পুকুর প্রস্তুতি এবং নার্সিং পুকুর প্রস্তুতি প্রায় একই রকম । যদি সম্ভব হয় পুকুরের পানি শুকিয়ে নিতে পারলে ভাল তা না হলে জাল টেনে বা মাছ মারার বিষ প্রয়োগ করে সব মাছ নিধন করে শিং মাছের পোনা ছাড়ার জন্য প্রস্তুত করতে হবে । শিং মাছের পুকুরে গোবর না দিলেও চলবে। মাছ ছাড়ার ৩ দিন আগে প্রতি শতাংশে ১ হারে চুন ২৫০ গ্রাম হারে লবণ প্রয়োগ করতে হবে । পুকুরে তলায় গ্যাস থাকলে গ্যাসটপ দিতে হবে। ভাইরাস প্রতিরোধ হিসাবে প্রতি শতাংশে ২ গ্রাম হরে টিমসেন বা ভাইরেক্স দেওয়া যেতে পারে । পুকুরের চারপাশে তিন ফোট উঁচু করে নেট জালে ঘের দিতে হবে।
পোনা মজুদ :
এপ্রিল থেকে নম্বেবর মাস পর্যন্ত দেশি শি মাছের পোনা পাওয়া যায়। দেশি শিং মাছ একক চাষের জন্য ৫০০ থেকে ১০০০ টি পোনা মজুদ করা যাবে। শিং মাছ চাষে পুকুরে ৪ – ৫ ইঞ্চি সাইজের প্রতি শতাংশে ৮ থেকে ১০ পিচ রুই , কাতল, গ্রাসর্কাপ , মৃগেল মাছের পোনা ছাড়তে হবে । কিছু কাপ জাতীয় মাছের পোনা ছাড়লে পুকুরের পরিবেশ ভাল থাকে । শিং মাছের পোনা পরিবহনের আগে ভাল করে এন্টিফাঈাস মেডিসিন দিয়ে গোসল করয়ে নিলে মাছ থাকে এবং রোগ বালাই হয় না।
২.২ শিং মাছের কালচার পুকুরে খাদ্য প্রয়োগ:
শিং মাছকে ভাসমান ফিস ফিড খাবার দিতে হবে। ছোট অবস্থায় পাউডার ফিড দিতে হবে। মাছ বড় হওয়ার সাথে সাথে দানাধার খাদ্য দিতে হবে। শিং মাছের খাবারে ৩০ – ৩৫ % আমিষ থাকতে হবে। শিং মাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য শর্করা ,চর্বি ,ফ্যাট , প্রাণীজ ও খনিজ এবং ভিটামিন পুষ্টি উপাদান থাকতে হবে। সাধারণত শিং মাছ রাতে ক্ষেতে পছন্দ করে । মাছ বড় হওয়ার সাথে সাথে দিনের ভেলায় খাদ্য খায়। প্রথম অবস্থায় ২ -৩ ইঞ্চি মাছের জন্য মাছের ওজনের ৩০% খাদ্য দিতে হবে। ১০ দিন অন্তর অন্তর মাছ বড় হওয়ার সাথে সাথে মাছের খাবার বাড়িয়ে দিতে হবে । শিং মাছ যখন কেজিতে ৪০ – ৫০ টি হবে তখন ওজনের ৩% হারে খাবার দিতে হবে।
পার্বতী রানী দেওয়ানজী
ডিপ্লোমা ইন ফিসারিজ,
চাঁদপুর
share:
