...
ব্রেকিং নিউজ
সিগারেট বাকীতে না দেয়ায় দোকানীকে ছুরিকাঘাতে হত্যা ⁜ স্বাস্থ্য সেবায় চট্টগ্রাম বিভাগে শ্রেষ্ঠ বরুড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ⁜ শিক্ষার্থীদেরকে মানসম্মত শিক্ষা দিতে হলে প্রথমে শিক্ষকদেরকে প্রশিক্ষিত হতে হবে ---শফিউদ্দিন শামীম (এমপি) ⁜ বরুড়ায় অবৈধ ভাবে ড্রেজার মেশিনে মাটি উত্তোলন করায় ভ্রাম্যমাণ আদালতে জরিমানা আদায় ⁜ বিভিন্ন মন্ত্রনালয়ের মাননীয় মন্ত্রীবর্গদের সাথে বরুড়া পৌরসভা মেয়র বকতার হোসেন'র সৌজন্যে সাক্ষাত ⁜ বরুড়ায় মরহুম আবু তাহের ফাউন্ডেশন কর্তৃক বিভিন্ন মসজিদের পরিচ্ছন্নতায় উপকরণ সামগ্রী বিতরণ ⁜ বরুড়ায় নব নির্বাচিত সংসদ সদস্য শফিউদ্দিন শামীম'র সাথে জনকল্যাণ সমিতির শুভেচ্ছা বিনিময় ⁜ কুমিল্লার ৪ আসনঃ শপথ নিলেন দেবিদ্বারের এমপি আবুল কালাম আজাদ ⁜ কুমিল্লা-৪ আসন: ঈগলের থাবায় ডুবল নৌকা! ⁜ কুমিল্লায় ৭টিতে আওয়ামীলীগ আর ৪টিতে স্বতন্ত্র বিজয়ী,নতুন মুখ ৬ ⁜

টুকরো স্মৃতি–২

স্বদেশ জার্নাল → প্রকাশ : 28 Aug 2022, 4:51:07 PM

image06
logo

হুমায়ূন আহমেদ সাহেব স্ত্রী গুলতেকিন ও আড়াই তিন বছরের মেয়ে শিলাকে নিয়ে পিরোজপুরের পালপাড়ায় আমার বাসায় সন্ধ্যার পরে পূর্ব নির্ধারিত ডিনারের দাওয়াতে এলেন। ইতোমধ্যে তিনি টানা চার দিন পিরোজপুর সরকারি কলেজে ( সোহরোয়ার্দী কলেজে ) রসায়ন বিভাগে বিএস,সি ব্যবহারিক পরীক্ষা নিয়েছেন। এই চার দিনে তাঁর সাথে একত্রে কাজ করে অনেকটাই ঘনিষ্ঠ হয়ে গিয়েছি। যেহেতু তিনি তাঁর ভগ্নিপতির বাসায় ওঠেছেন এবং ওখানেই খাওয়া দাওয়া করেছেন, তাই ঢাকায় ফিরে যাওয়ার আগে পরীক্ষার শেষ দিন রাত্রে তাঁকে সপরিবারে আমার বাসায় ডিনারের নিমন্ত্রণ করেছিলাম। তিনি বড়ো মেয়ে নোভা আহমেদ ও তিন মাস বয়সী বিপাশাকে সাথে আনেননি। পিরোজপুরের রিক্সায় দুই জনের বেশি বসা যায় না সেটা ভেবেই হয়তো বড়ো মেয়েকে আনেননি, আর কোলের বাচ্চা নিয়ে মুভ করা ঝামেলা সেটা ভেবেই হয়তো ওকে ঘুম পাড়িয়ে বাসায় রেখে

এসেছেন।

আমি ও আমার ওয়াইফ তাঁদেরকে রিসিভ করে সামনের রুমে বসালাম। ঘরের হালত খুব একটা ভালো না। কাঠের ঘর। পিরোজপুরে তখন বেশির ভাগ ঘরই ছিলো কাঠের, কারও আবার দু'তলা কাঠের ঘর ছিলো। শহরে বিল্ডিং ছিলো হাতে গুণা, ভাড়া নেওয়ার মতো কোনো বিল্ডিং পাওয়া যেতো না, তবে তিন বছর সেখানে কাটানোর পর একটা বিল্ডিং ভাড়া পেয়েছিলাম।

সকলে কিছুক্ষণ আলাপের পর আমার ওয়াইফ গুলতেকিনকে ভেতরের রুমে নিয়ে গেলো। ওরা ভেতরে যাওয়ার পর হুমায়ূন আহমেদ স্যার সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন আপনিতো আমাকে একেবারে পুরোপুরি সিগারেটখোরই বানিয়ে ফেললেন। উল্লেখ্য যে ব্যবহারিক পরীক্ষা চলাকালীন প্রতি দিন স্যারকে এক প্যাকেট ৫৫৫ সিগারেট দিতাম এবং বিগত চার দিনে তিনি ৮০টি সিগারেট খেয়েছেন। উনি আরও বললেন আমি যে খুব একটা বেশি স্মোক করি তা কিন্তু নয়, এই ধরেন দিনে ৪/৫ টা সিগারেট খাই।

হুমায়ূন সাহেব কথাবার্তা খুব কম বলেন। অনেকটাই ইনট্রোভার্ট বলা চলে। একজন নিভৃতচারী মানুষ তিনি। নিজেকে প্রচার করা বা সভা সমাবেশে তাঁকে হাইলাইট করা মোটেও পছন্দ করতেন না তিনি। পরীক্ষা নিতে আসার পর থেকেই পিরোজপুরের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, সুশীল সমাজের লোকজন তাঁকে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য আমাকে অনুরোধ করতো উনাকে বলার জন্য। বিশেষ করে কলেজের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের সিনিয়র শিক্ষক মাহবুব উল আলম, অর্থনীতির মোঃ ইউনুস এবং জি, কে টাউন ক্লাবের ( গোপাল কৃষ্ণ টাউন ক্লাবের ) সম্পাদক মোঃ আকরাম হোসেন ক্লাবের পক্ষ থেকে হুমায়ূন সাহেবকে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য আমাকে বার বার অনুরোধ করে।

জি, কে টাউন ক্লাবের সদস্য না হলেও আমি প্রায়ই ক্লাবে যেতাম। ঐ ক্লাবে কন্ট্রাক্ট ব্রিজ ও ডুপ্লিকেট কন্ট্রাক্ট ব্রিজ খেলতাম এবং মাঝে মাঝে ঢাকা থেকে টিম এসে ঐ ক্লাবে কন্ট্রাক্ট ব্রিজ ও ডুপ্লিকেট কন্ট্রাক্ট ব্রিজের টুর্নামেন্টের আয়োজন করতো এবং সে খেলায় আমিও অংশ গ্রহণ করতাম। তাছাড়া ঐ ক্লাবে মাঝে মধ্যে লন টেনিস ও খেলতাম। এ জন্য আমি ক্লাবের প্রায় সদস্যের কাছেই পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ ছিলাম। আমি অবশ্য পিরোজপুর অফিসার্স ক্লাবের নিয়মিত সদস্য ছিলাম যেখানে প্রশাসনসহ সব সরকারি কর্মকর্তা ও ব্যাংক কর্মকর্তারা সদস্য ছিলেো। তারাও হুমায়ূন আহমদের সংবর্ধনার জন্য আমাকে বলেছে।

হুমায়ূন সাহেবকে পিরোজপুরের সুশীল সমাজ কর্তৃক নাগরিক সংবর্ধনা জ্ঞাপনের ব্যাপারে অনুরোধ করলে তিনি বিনয়ের সাথে বলেন আছাদ সাহেব, আমি আসলে ওগুলো পছন্দ করি না। এখানে আসছি মূলত পরীক্ষা নিতে আর বোন ও তার পরিবারকে দেখতে। আনুষ্ঠানিকতা আমার মোটেও ভালো লাগে না। ওদেরকে একটু বুঝিয়ে বলবেন। উনার কথা শুনে আমি নিজেও হতাশ হলাম এবং পিরোজপুরের সুশীল সমাজ খুবই হতাশ হলো, হুমায়ূন আহমেদের মতো একজন জনপ্রিয় লেখককে এতো কাছে পেয়েও একটি সংবর্ধনা দেওয়ার সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত হলো। এ যেন তাদের এক বিরাট অতৃপ্তি।

অনেক ক্ষণ দু'জনে গল্পগুজব করলাম। আমি উনাকে বললাম স্যার আপনিতো নন্দিত নরকে এক রাত্রে লিখেছেন আর আমি আপনার এই বইটি রাতে খাবারের পর এক বসায় পড়ে শেষ করে তবেই ঘুমুতে গিয়েছি। আসলে অনেক লেখকের লেখায় একটা মোহময়তা থাকে, যেটা পাঠককে বইটি পড়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত আকর্ষণ করতেই থাকে। যার জন্য শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের "পার্থিব " বইয়ের মতো বিশালাকার একটি উপন্যাস মাত্র ৪/৫ দিনেই পড়ে শেষ করেছি, তদ্রূপ শহীদুল্লাহ কায়সারের বিশাল উপন্যাস "সংশপ্তক " ফিদর দস্তভয়েস্কি'র "ক্রাইম এন্ড পানিস্মেন্ট " অতি স্বল্প সময়ে শেষ করেছি। তবে কিছু কিছু বড়ো বই বেশ সময় নিয়ে খুব ধীরে ধীরে পড়তে হয়েছে প্রকৃত রস আহরণ ও বিষয়বস্তুর মর্মার্থ বুঝার জন্য, যেমন রবীন্দ্রনাথের "গোরা", শরৎ চন্দ্রের চরিত্রহীন ততো বড়ো না হলেও প্রকৃত রসাস্বাদনের জন্য অনেক সময় নিয়ে পড়েছি।

খাবার দাবার তো এখনও আসছে না। আমার ওয়াইফ ও ভাবী দু'জনে মনে হয় জমিয়ে আড্ডা দিয়ে মনের যতো কথা আছে সব বলে শেষ করে নিচ্ছে। অবশেষে আমরা দু'জন যেখানে বসেছিলাম সেখানেই খাবার আনা শুরু হলো। রান্না ঘরটা ছিলো আলাদা। সেটা একটু বড়োসড়ো গুলপাতার ঘর। আর রান্না হতো স'মিলের কাঠেরগুড়ি দিয়ে মাটির চূলায়। রান্না ঘর হতে আমার ওয়াইফ ও কাজের মেয়েটার সাথে গুলতেকিনও খাবার আনায় যোগ দিলো। আমার ওয়াইফের বারণ সত্ত্বেও গুলতেকিন হাসিমুখে তাদের সাথে রান্না ঘর থেকে খাবার আনতে লাগলো।

আমার কাছে অনেকটা আশ্চর্যই লাগলো গুলতেকিনের হাসিমুখে খাবার সরবরাহে অংশগ্রহণ করা দেখে। আমাদের এই পর্ণকুটিরের মতো নিবাসে যেখানে নেই কোনো সোফাসেট, নেই কোনো ডাইনিং টেবিল, নেই কোনো সিলিং ফ্যান বা টেবিল ফ্যান, থাকার জন্য নেই কোনো খাট, আছে কলেজ থেকে ধার করা দুটো চৌকি, সস্তা দামের একটা অতি অর্ডিনারি টেবিল ও কয়েকটা চেয়ার, যে ঘরে কেউ ঢুকলে অস্বস্তিতে নাক সিটকানোর কথা, সেখানে এই একজন অতি জনপ্রিয় সেলিব্রেটির ওয়াইফের হাসিখুশি ও স্বাচ্ছন্দ্যবোধের সহিত আমার ওয়াইফের সহিত দীর্ঘ সময় ধরে মন খুলে গল্পগুজব করা ও রান্নাঘর থেকে খাবার আনা নেওয়ায় সহায়তা করা আমাকে সত্যিই মুগ্ধ ও বিমোহিত করে।

পরে আমার ওয়াইফের কাছ থেকে জেনেছি গুলতেকিনের এই মিশুকতা, প্রাণখোলা আলাপচারিতা ও সহজ সরলতায় সে প্রশংসায় পঞ্চমুখ। পরবর্তীকালে আমার ওয়াইফ গুলতেকিনের একজন পরম ভক্ত ও গুণমুগ্ধ হয়ে যায় এবং হুমায়ূন আহমেদ সাহেবের দ্বিতীয় বিয়েটা মন থেকে একেবারেই মানতে পারেনি এবং হুমায়ূন সাহেবকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত খুবই অপছন্দ করতো দ্বিতীয় বিয়ের কাবণে। আর গুলতেকিনের দ্বিতীয় বিয়েটাতেও আমার ওয়াইফের পূর্ণ সমর্থন ছিলো।

আমার বাসার গরিবি হালতের জন্য কিছু কারণ ছিলো। পিরোজপুর সরকারি কলেজে আসার আগে আমি ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে রসায়নের প্রভাষক হিসেবে চাকুরি করতাম। ওখানে ফ্রি ফার্নিশ্ড কোয়াটার ছিলো। রাজার হালতেই থাকতাম চারিদিকে খোলা জায়গা গাছগাছালীসহ বড়ো বাসায়। কিন্তু শুধুমাত্র বেতন ছাড়া টাকা কড়ি উপার্জনের অন্য কোনো উপায় যেমন ছাত্র পড়ানো, বোর্ডের উত্তরপত্র মূল্যায়ন, বাহিরের কলেজে পরীক্ষা নিতে যাওয়া ইত্যাদির কোনো সুযোগ ছিলো না, পেনশন সুবিধা ছিলো না। ভবিষ্যতটা ছিলো অনেকটা অনিশ্চিত। অন্য চাকুরি খোঁজার সময় ও সুযোগও পাওয়া যেতো না। আবার ছুটিছাটাও খুব একটা মিলতো না। কোনো এক সময়ে ক্যাডেট কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় ঢাকা যাওয়ার সুযোগ পেয়ে এরই ফাঁকে সরকারি কলেজের জন্য পি,এস,সি ( পাবলিক সার্ভিস কমিশন ) পরীক্ষাটা দিয়েছিলাম। পরীক্ষায় টিকবো কিনা বা টিকলে পোস্টিং কোথায় নিতে পারবো তার কোনো খবরাখবর নিতে পারিনি।

অবশেষে যখন সরকারি কলেজে চাকুরি হলো পিরোজপুরে, যার নাম আগে কখনও শুনিইনি, তখন সেখানে যোগ দানের জন্য ক্যাডেট কলেজ থেকে অনেক কষ্টে রিলিজ হয়ে কুমিল্লায় চলে আসি এবং বড়ো ছেলেকে মিশনারি স্কুলে ভর্তি করিয়ে এবং ফ্যামিলি কুমিল্লায় রেখে সেই সুদূর পিরোজপুরে চলে আসি। পিরোজপুরে এসে কলেজের উত্তর পূর্ব দিকে কলেজের লাগোয়া ছাত্রদের হোস্টেলে একটি রুমে ওঠি। এখানে দিনগুলো ভালোই কাটছিলো। হোস্টেলের খাবার পিয়ন রুমে দিয়ে যেতো।

আমার রুমটি ছিলো টিনশেড হোস্টেলের সর্বশেষ প্রান্তে রাস্তার সাথে। ইচ্ছে ছিলো যতো দিন বদলি হতে না পারবো ততোদিন এখানেই থাকবো। ফ্যামিলি কুমিল্লায়ই থাকবে। কিন্তু সব কিছু ওলট-পালট করে দিলো আমার এক একাদশ বিজ্ঞানের সুন্দরী ছাত্রী। ঐ ছাত্রীটি বিকেল বেলায় আমার রুমে চলে আসতো। হাতে বই থাকতো। প্রথম প্রথম ভাবতাম হয়তো পড়াশোনার বিষয়ে কিছু বুঝতে আসছে। কিন্ত বুঝতে পারলাম সে রকম কিছু নয়। এমনিতেই আসে। আমি কিছুটা অস্বস্তিবোধ করতাম। সে আসলে আমি আমার স্ত্রী সন্তানদের প্রসঙ্গ তুলতাম, তাদের নিয়ে কথা বার্তা বলতাম, উদ্দেশ্য একটাই, তাকে অবগত করানো যে আমি বিবাহিত এবং আমার সন্তানাদি আছে, এগুলো জানলে হয়তো তার মনে আমাকে নিয়ে অন্য ধরনের কোনো চিন্তা ভাবনা থাকলে সে আর এখানে আমার কাছে আসবে না। কিন্তু সে নাছোরবান্দা, তারপরও সে আসতো।

তাকে এভোয়েড করার জন্য সে আসলে আমি আছর নামাজে দাঁড়িয়ে যেতাম। বেশ লম্বা সময় নিয়ে নামাজ পড়তাম যাতে সে বিরক্তবোধ করে চলে যায়। কিন্তু নামাজ শেষে দেখতাম সে বসে আছে। আমি এটাও জানতাম এবং দেখেছি যে এই মেয়েটা দ্বাদশ শ্রেণির আমার এক প্রিয় ছাত্র যে ছাত্রলীগের নেতাগুছের এবং এলাকার প্রতাপশালী শিকদার পরিবারের ছেলে, তার সাথে একত্রে ঘোরাঘুরি করে এবং ছেলেটি তাকে ভালোবাসে।

মেয়েটির ঘনঘন আসার কারণে আমার মধ্যে একটা উৎকণ্ঠা শুরু হলো। একেতো এটি ছেলেদের হোস্টেল, এখানে একটা মেয়ের ঘনঘন আসা ছেলেরা হয়তো বাঁকা চোখে দেখতে পারে, দ্বিতীয়ত আমার রুমটি একেবারে মেইন রাস্তার সাথে যেখান দিয়ে প্রচুর লোকজন আসা যাওয়া করে এবং জানালা দিয়ে বসা মেয়েটাকে দেখা যায়, এলাকার লোকজন বা পথচারীরা নানা কিছু ভাবতে পারে। এ সমস্ত চিন্তায় কিছুটা অস্থির হয়ে ওঠলাম। মনে মনে ভাবলাম আরও কিছুটা দিন যাক, দেখি না মেয়েটা আসা বন্ধ করে কিনা। কিন্তু না, ওর আসা আরও বেড়ে গেলো।

এই সেন্সিটিভ ইস্যুটি নিয়ে কারো সাথে আমি পরামর্শ করবো বা শেয়ার করবো সে সাহসও পাচ্ছিলাম না,পাছে আবার কেউ অন্য কিছু ভাবে বা এটা নিয়ে কানাঘুষো শুরু হয়। আবার মাঝে মাঝে ভাবি মেয়েটাকে বলে ফেলি যে এখানে এভাবে তোমার আসা ঠিক না, এটা ছেলেদের হোস্টেল, ছাত্ররা বা অন্য কেউ কিছু মনে করতে পারে, পরক্ষণেই আবার ভাবি, এতে যদি মেয়েটা মাইন্ড করে, আমিতো জানি না মেয়েটার মনে কী আছে, ওতো নিজের সম্পর্কে আমাকে কিছু বলেনি, আমার কথায় সে হয়তো উল্টো আমাকেই নিচু মনা ভাবতে পারে, তার অন্তরে যদি অন্য কিছু না থাকে তাহলে সে হয়তো মনে মনে ভাবতে পারে এ আবার কেমন শিক্ষক, এতো নিম্ন মন মানসিকতার, আমি আমার স্যার, আমার শিক্ষককের কাছে আসি এতে কারও কি অন্য কিছু ভাবার আছে। এটা ভেবে আমি মনে মনে লজ্জাবোধ করে আর ওকে কিছু বলিনি।

কিন্তু মানসিক অশান্তি আমাকে দিন দিন তাড়া করে ফিরছে, নিজের মান সম্মান, ইজ্জতের ব্যাপার যেখানে জড়িত। এই ছোটো মফস্বল মহকুমা শহরে অন্য কোথাও থাকারও ব্যবস্থা নেই। এই সংকটময় নাজুক অবস্থা থেকে পরিত্রাণের একটা মাত্র উপায় আছে, তা হলো একটা বাসা ভাড়া করে ফ্যামিলি নিয়ে আসা। আমি জানি যে এতে হয়তো আমার সাময়িক অনেক অসুবিধা হবে তারপরেও তাড়াহুড়া করে এই বাসাটি যেটিতে হুমায়ূন স্যার এসেছেন, এটি আমার সহকর্মী রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সিনিয়র শিক্ষক করিম সাহেবের বাসা, যার অর্ধেকটায় উনি থাকেন, বাকি অর্ধেকটা আমি ভাড়া নিয়েছি। মাঝ খানে কাঠের তক্তা দিয়ে পার্টিশন দেওয়া আছে। কোনো আসবাবপত্র নেই, থাকার জন্য কলেজ থেকে দুটো চৌকি অধ্যক্ষ মহোদয়ের কাছে লিখিত আবেদন করে ধার নিয়েছি এবং কুমিল্লায় এসে ওয়াইফকে বিস্তারিত বলে সবাইকে নিয়ে বাসায় ওঠেছি। তারপর আস্তে ধীরে অতি অপরিহার্য কিছু সামগ্রী ক্রয় করেছি, কারণ এখান থেকে বদলি হলে কোনো সামগ্রী নিয়ে যেতে পারবো না সেটা মাথায় ছিলো। আবার শখ করে কোনো কিছু কেনার প্রবৃত্তিকেও দমন করেছি, কারণ ৭৫০ টাকা বেতন স্কেলের চাকুরি করে দু'সন্তানসহ চার জনের সংসার চালানো এবং কুমিল্লায় কিছুটা অসচ্ছল আমার বিধবা শাশুড়ির পরিবারে প্রতি মাসে দু'শত টাকা পাঠানো ইত্যাদি কারণে বেশ হিসেব করেই চলতে হতো।

এই বাসায় আসার মাস চারেক পরে আমার সেই ছাত্রীটি আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু গীতিশ বাবুর মেয়ে তাপসীকে নিয়ে আমার বাসায় এলো। তাপসীও আমার ছাত্রী এবং ঐ মেয়েটির ক্লাশমেট। গীতিশ বাবু এবং তাপসী এই বাপ বেটি এবং তাপসীর মা আমার বাসায় আসতো, আমিও ওদের বাসায় গিয়ে আড্ডা দিতাম, আমার ওয়াইফও গীতিশ বাবুর বাসায় যেতো এবং গীতিশ বাবুর ওয়াইফের সাথে সুখ দুঃখের গল্প শেয়ার করতো। দুটো পরিবারের মাঝে একটা মধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আমার আপদে বিপদে গীতিশবাবু ঝাঁপিয়ে পড়তেন। বয়সে উনি আমার চাইতে অনেক বড়ো হলেও সম্পর্কটা ছিলো ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতো। তাপসী ভালো গান করতো, আমি তাদের বাসায় গেলে গীতিশ বাবু আার আমি চা খেতে খেতে তাপসীর গান শুনতাম। দু'জনের বাসা একই রোডে কাছাকাছিই ছিলো।

তাপসীর সাথে মেয়েটি বাসায় এসে আমার ওয়াইফের সাথে কথাবার্তার এক পর্যায়ে আমার ওয়াইফকে তার মনে পুষে রাখা সেই গোপন কথাটা প্রকাশ করে বলল, জানেন ভাবী, আছাদ স্যারকে আমার খুব ভালো লাগে, আমি স্যারকে ভীষণ ভালোবাসি। আমার ওয়াইফ এ কথা শুনে কিছুটা বিব্রতবোধ করলেও এবং মনে কিছুটা আঘাত লাগলেও যেহেতু আগে থেকেই ব্যাপারটি তার জানা ছিলো, পরিস্থিতি সামলে নিয়ে ওকে বলে, হ্যাঁ, উনিতো তোমার স্যার, তোমার শিক্ষক, শিক্ষককে সবাই শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে। এ কথা শুনে মেয়েটি চুপসে গেলো। ওদিকে তাপসী তো এতো সব কিছু জানতো না, সে কিছুটা লজ্জিত হয়ে আমার ওয়াইফকে একটু আড়ালে নিয়ে বললো, কাকীমা আপনি মনে কিছু নিবেন না, ও মেয়েটা এমনই, কেমন জানি একটু পাগলাটে টাইপের। কাকে কী বলতে হয় বুঝে না। ওকে নিয়ে আমি আর কখনও এখানে আসবো না। আমি মনে মনে ভাবলাম হোস্টেল ছেড়ে বাসা নেওয়ার সিদ্ধান্তটা আমার সঠিকই ছিলো, নইলে বড়ো ধরনের একটা ঝামেলায় হয়তো পড়ে যেতাম। মেয়েটি এরপর আর কখনও আমার বাসায় আসেনি।

মেহমান নিয়ে খাওয়া দাওয়া শুরু হলো। খাবার আয়োজন মোটামুটি ভালোই ছিলো। পিরোজপুরে বড়ো বড়ো শিং মাছ খুব সস্তায় পাওয়া যেতো, ডিমওয়ালা সেই শিং মাছের আস্ত ভোনা, যা হুমায়ূন সাহেবের খুবই প্রিয়, বলেশ্বর নদীর বড়ো সাইজের কাঁঠালি চিংড়ির মচমচে ভাজা, পিরোজপুরে আর একটা জিনিস খুব সস্তায় পাওয়া যেতো, তা হলো বেশ মোটাসোটা কবুতরের বাচ্চা তার মাংস ভোনা ছিলো, মুরগির মাংস, গোরুর মাংস, সবজি, ডাল, পলাউ, সাদা ভাত ও পায়েস। মেহমান বেশ তৃপ্তির সাথেই খেয়েছে বুঝতে পারলাম।

খাওয়া দাওয়ার পর বিদায় নেওয়ার আগে হুমায়ূন সাহেবকে বললাম স্যার আপনার বাসার ঠিকানাটা দেন লিখে রাখি। উনি বললেন লিখলে হারিয়ে ফেলবেন তার চেয়ে বরং আমি বলি আপনি ভুলবেন না, "শ্যামলি 2- E " । আসলে উনি ঠিকই বলেছিলেন লিখে রাখলে হয়তো কবেই হারিয়েই যেতো কিন্তু সেই "শ্যামলি 2-E " আজও মনে আছে।

বিদায় নেবার সময় মনে হলো ওরা আমাদের কতো চেনাজানা আপন লোক যেন দূরে চলে যাচ্ছে।

এরপরও আমার পি-এইচ,ডির রিসার্চ সংক্রান্ত কাজে হুমায়ূন আহমদ স্যারের সাথে দুই তিন বার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা করেছি, উনার পরামর্শ নিয়েছি।

আজ সুদীর্ঘ দিন পরে মনে হয় এ জীবনে অনেক ভালো পরিবেশে অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, পদস্ত অনেক কর্মকর্তাকে বাসায় দাওয়াত দিয়ে আপ্যায়ন করেছি কিন্তু সে দিনের সে দৈনদশার কাঠের কুটিরে হুমায়ূন আহমেদ, গুলতেকিন ও ছোটো শিলাকে খাওয়ানোর মধ্যে যে তৃপ্তি, আনন্দ ও সন্তুষ্টি পেয়েছিলাম তেমনটা আর কখনও পাইনি।


share:
Today
প্রিন্ট নিউজ
...
বিজ্ঞাপন
সময়
সর্বশেষ
➤ সিগারেট বাকীতে না দেয়ায় দোকানীকে ছুরিকাঘাতে হত্যা
➤ স্বাস্থ্য সেবায় চট্টগ্রাম বিভাগে শ্রেষ্ঠ বরুড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে
➤ শিক্ষার্থীদেরকে মানসম্মত শিক্ষা দিতে হলে প্রথমে শিক্ষকদেরকে প্রশিক্ষিত হতে হবে ---শফিউদ্দিন শামীম (এমপি)
➤ বরুড়ায় অবৈধ ভাবে ড্রেজার মেশিনে মাটি উত্তোলন করায় ভ্রাম্যমাণ আদালতে জরিমানা আদায়
➤ বিভিন্ন মন্ত্রনালয়ের মাননীয় মন্ত্রীবর্গদের সাথে বরুড়া পৌরসভা মেয়র বকতার হোসেন'র সৌজন্যে সাক্ষাত
➤ বরুড়ায় মরহুম আবু তাহের ফাউন্ডেশন কর্তৃক বিভিন্ন মসজিদের পরিচ্ছন্নতায় উপকরণ সামগ্রী বিতরণ
➤ বরুড়ায় নব নির্বাচিত সংসদ সদস্য শফিউদ্দিন শামীম'র সাথে জনকল্যাণ সমিতির শুভেচ্ছা বিনিময়
➤ কুমিল্লার ৪ আসনঃ শপথ নিলেন দেবিদ্বারের এমপি আবুল কালাম আজাদ
➤ কুমিল্লা-৪ আসন: ঈগলের থাবায় ডুবল নৌকা!
➤ কুমিল্লায় ৭টিতে আওয়ামীলীগ আর ৪টিতে স্বতন্ত্র বিজয়ী,নতুন মুখ ৬
➤ কুমিল্লা ৪ আসনে ঈগলের ঝাপটায় ডুবল নৌকা!
➤ দেবীদ্বারে স্বতন্ত্র প্রার্থীকে হুমকি দেয়ায় , সেচ্ছাসেবকলীগ নেতার বিরুদ্ধে মামলার নির্দেশ
➤ ব্রাহ্মণপাড়ায় সাংবাদিকদের সাথে সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার মতবিনিময়
➤ আগামী ৭ তারিখ প্রমাণ করতে হবে কুমিল্লার জনগন শেখ হাসিনার পক্ষে,উন্নয়নের পক্ষে, গনতন্ত্রের পক্ষে - এমপি বাহার
➤ কুমিল্লার ১১টি আসনের ৯৩ জন প্রার্থী শেষ দিনে জমজমাট প্রচারণা
➤ চৌদ্দগ্রামে মুজিবুল হকের নির্বাচনি জনসভায় মানুষের ঢল নেমেছে
➤ কুমিল্লা-৬ আসনের বাহার ও সীমার মধ্যে ভোটের লড়াই দেখতে পাচ্ছেন না ভোটাররা
➤ কুমিল্লা ৪ আসনে অন্য প্রার্থীর এজেন্ট সেজে কাজ করছেন মেয়রসহ নৌকার গুরুত্বপূর্ণ সমর্থকরা
➤ কুমিল্লা-৫ বুড়িচং সদরে নৌকা প্রতীকের গণমিছিলে জনতার ঢল
➤ বরুড়ায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে কর্মরত সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় সভা
➤ বাসের জানালা দিয়ে লাফিয়ে প্রাণে বাচঁলো ভিক্টোরিয়ার শিক্ষার্থীরা
➤ তরুন সংগঠক সাংবাদিক বেলাল হোসেন রাজু
➤ শিল্পসাহিত্যের ছোটকাগজ 'স্মৃতির পাতা'
➤ নারী নেত্রী নাছরিন আক্তার মুন্নি
➤ বরুড়া গামারুয়া জাগ্রত সমাজকল্যাণ সংগঠনের নব গঠিত কমিটি ঘোষণা
© All rights reserved © 2022 swadeshjournal.news
Design & Developed by : alauddinsir