বদলে যাওয়া পাঠাভ্যাস

স্বদেশ জার্নাল → প্রকাশ : 5 Feb 2023, 8:11:30 AM

image06

মাসুক আলতাফ চৌধুরী 

 

আগের মতো বইয়ের পাঠক নেই। ছেলেমেয়েরা সব প্রযুক্তির দিকে ঝুঁকছে। মোবাইল প্রযুক্তির বিকাশ ও ব্যপ্তি দিন দিনই বাড়ছে। জাতীয়ভাবেই আমাদের পড়ার অভ্যাস কমে গেছে। পাশাপাশি পাঠাগারে যাওয়ার অভ্যাসও কমে গেছে। এইযে কমে যাওয়া এটা এক রুপান্তরের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। অধিকাংশই এখন আর বইয়ের মানুষ নই, স্ক্রিনের মানুষ। এ এক গতিময়তা। ইন্টারনেটের সাথে বেড়ে ওঠারা পাঠাভ্যাসের এ রুপান্তর সম্পর্কে সচেতন। পড়ুয়াদের কাছে ছাপাবই মূলমাধ্যমের স্থান ধরে রাখতে পারছে না। সে জায়গা করে নিয়েছে ডিজিটাল বিকল্প মাধ্যমগুলো- ইন্টারনেট প্ল্যাটফরম।

৪৪ হাজার বইয়ের সরকারি পাবলিক লাইব্রেরি বা গণগ্রন্থাগার কুমিল্লা আদালত সড়কের ছোটরা কলোনিতে নিজস্ব ভবনে। চেনেন ক'জন। জানেন না অনেকেই। সব জেলা শহরেই সরকারি গণগ্রন্থাগার রয়েছে। যেখানে পাঠক সমাগম খুব একটা চোখে পড়ছে না। এটি ঠিক শহরের কেন্দ্রস্থলে নয়, বেশ দূরেও নয়। এক পাশে। সেখানে ১শ'২০ জন পাঠকের চেয়ার টেবিলে বসে পড়ার সুযোগ রয়েছে। তাদের দাবী ৭০ জনের মতো আসেন প্রতিদিন। প্রতিদিন ১০ টি প্রত্রিকা রাখা হয়। আছে শিশুকর্ণার, মেয়েদের জন্যে আলাদা ব্যবস্থা। স্কুল-কলেজের পাঠ্যবইয়ে পাঠক বেশি।  আর আসেন চাকুরীর প্রস্তুতি নেয়ারা। এরপর প্রত্রিকার পাঠক। সৃজনশীল বইয়ের পাঠক একেবারে সামান্য। সদস্য হয়েছেন  মাত্র ১৭০ জন। সদস্যরা একসাথে দু'টি বই নিতে পারেন। রাখতে পারেন ১৫ দিন। সরকারী ছুটি- শুক্র ও শনি দুইদিনই বন্ধ থাকে। খোলাও তাকে সরকারি অফিস সময় ৯-৪ টা। এটাকে অসুবিধাই মনে করেন পাঠকরা। সরকারী বলে এই নিয়মে চলছে। তবে একাডেমিক পাঠাগার হলে দিন- সময়ে পরিবর্তন আনা যেত। অবশ্য কান্দিরপাড় শহরের প্রাণকেন্দ্রেই রয়েছে প্রাচীনতম বৃহৎ বীর চন্দ্র গণপাঠাগার। সেখানেও পাঠক নেই আগের মতো।

সরকার অবশ্য নতুন পাঠক তৈরির চেষ্টা করছে। বিভিন্ন প্রকল্প নিয়েছে। কাজের কাজ তেমন হয়নি। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমান পাঠাগার এলাকায় এলাকায় যাচ্ছে। মূল যারা পাঠক সেই স্কুল-কলেজে পড়ুয়ারা ক্লাসের পড়ার চাপে পাঠাগারে আসতে পারছে না। তাই নতুন পাঠক তৈরি হচ্ছে না তেমন করে। পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার সামাজিক আন্দোলনগুলোও থেমে গেছে। মহল্লায় মহল্লায় পাঠাগার কার্যক্রম চোখে পড়ছে না। সমাজ এতে মনোযোগ হারিয়েছে।

মানুষ কাগজে ছাপা বই পড়বে না। এমন আশঙ্কা এখনও অমূলক প্রমাণিত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী ছাপা বইয়ের বিক্রি বাড়ছে। আমাদের বই মেলা চলছে। কাগজ-ছাপা- বাঁধাইয়ের মূল্য বহগুণ বেড়ে গেলেও বই প্রকাশ বন্ধ নেই। পাঠকও আছে। যদিও বলা হচ্ছে লেখক বেড়েছে, পাঠক বাড়ে নি।

মানবসভ্যতার কয়েক হাজার বছর মানুষের যোগাযোগ মাধ্যম ছিল মূলত মৌখিক। পঞ্চদশ শতাব্দীতে ছাপামেশিনের আবিস্কার। শিল্পবিপ্লব, কাগজ উৎপাদন বই পাঠে আমূল পরিবর্তন আনে। শিক্ষা, সংবাদ, সাহিত্যের মূলধারার ব্যাপার হয়ে ওঠে বই, সাথে পাঠাগার আর বইয়ের দোকান। কয়েকশ' বছর ধরে চলে ছাপা হরফের একচেটিয়া আধিপত্য। বিংশ শতাব্দীতে এ ধারাকে প্রথমবার চ্যালেঞ্জ জানায় টেলিভিশন। একুশ শতকের তৃতীয় দশকের শুরুতে এসে ইন্টারনেট- ই-রিডার, ট্যাবলেট, স্মার্টফোন- প্রযুক্তির নতুন মাধ্যমেগুলো লিখিত অক্ষরের সাথে আমাদের সম্পর্ককে নাটকীয় ভাবে বদলে দিয়েছে।

পাঠক হিসেবে আমরা গভীর এক রুপান্তরের মধ্য দিয়ে এগুচ্ছি। ফেসবুক, ভিডিও গেমস, বা পাঠের ইন্টারনেট প্লাটফর্মগুলোর কারণে প্রথাগত বইপড়া ও গল্পবলার ধরনেও প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।

এই প্লাটফর্ম অনেক বেশি ভিজ্যুয়াল। যেখানে অক্ষরের সাথে ইমেজ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। মিলমিশের এই নতুন মাধ্যমকে  দেখার বই বা পড়ার টিভি বলা হচ্ছে।  দ্রুততার সাথে টেক্সট স্ক্রিনের দিকে ধাবিত হচ্ছে। ইউটিউব  বা ওটিটি প্লাটফর্মগুলোতে সিনেমা বা সিরিজ দেখার সময় টেনে টেনে দেখার সুযোগ আছে, পাঠকদের মধ্যেও তেমন স্কিপ করার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। এক অর্থে এটা যতটা না পড়া (রিডিং)  তার চেয়ে বেশি স্ক্রিনিং। এটা কতোটা বোধগম্যতা তৈরি করে। চিন্তার প্রসার ঘটায়। চেতনাকে নাড়া দেয়। পরবর্তীতে যা পরিবর্তন আনে। তার মানে এর প্রভাব। এটা আরও গভীর আলোচনা। প্রাসঙ্গিক হলেও ভিন্ন অবতারণা।

লেখকের মধ্যে তাই বেশি প্যারাগ্রাফিং, ছোট বাক্য লেখার প্রবণতা বাড়ছে। দীর্ঘ অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত প্রায়। কেউ শুধু শিরোনাম,  কেউ আরেকটু বেশি, একেবারে সামান্য পুরোটা পড়ছে। পাঠকের মনোযোগ পেতে লেখককে এখন রীতিমতো সংগ্রাম করতে হচ্ছে। প্রতিযোগিতা চলছে পাঠকের মনোযোগ কাড়ার। ডিজাইন, প্রচ্ছদ চিন্তাও করা হচ্ছে ই- প্লাটফর্মকে মাথায় রেখেই। রীতিমতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। বিনোদনের অসীম বিকল্প রয়েছে, অথচ মানুষের সময় ও মনোযোগ অত্যন্ত সীমিত। সম্পূর্ণ লেখা মনোযোগ দিয়ে পড়ার পাঠক দিন দিন কমছে। যে করেই হোক পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ, কাছে পৌছায়ই বড় কথা। সংবাদ মাধ্যম, সাহিত্য,  কাগজে ছাপা বই- এসব  এর  সাথে কঠিন পাল্লা দিয়ে এগুচ্ছে।

এভাবে বলা যায়, বই ও স্ক্রিন সংস্কৃতির এক টানাপোড়েন চলছে। কে জিতবে। বোধকরি স্ক্রিন সংস্কৃতি। কাগজের বইয়েও এই স্ক্রিন সংস্কৃতি আগামী দিনগুলোতে হতে যাচ্ছে এক অনিবার্য বাস্তবতা।

লেখকঃ সাংবাদিক।


Share

© All rights reserved © 2022 swadeshjournal.news Design & Developed by : alauddinsir